অসংখ্য সাহাবি ও তাবেঈনের মাধ্যমে হাদিস বর্ণনার ধারা অগ্রসর হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম একে অপরের কাছে অপরিচিত ছিলেন না।
তারা একটি মহাকেন্দ্রের চারপাশে অনবরত আবর্তিত হয়েছেন। তাই প্রত্যেকে প্রত্যেকের সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবগত।
এরপর নবী (সা.)-এর ওফাতের পর তারা যখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন তখন তাবেঈনের বিশাল জামাত তাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। একইসঙ্গে হাদিস শরিফের বিভিন্ন কেন্দ্রে সাহাবা-তাবেঈনের সফর ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অধ্যায়।
এভাবে তাবেঈনরা যেমন সাহাবায়ে কেরামকে জেনেছেন, তেমনি জেনেছেন তাদের সমসাময়িক ও সহগামী তাবেঈনদেরও। হাদিস শরিফের বর্ণনাধারা এভাবেই সামনে অগ্রসর হয়েছে।
সাহাবায়ে কেরাম লিখনীর মাধ্যমেও হাদিস সংরক্ষণ করেছিলেন, যার কিছু আলোচনা আমরা সামনে করব। তবে হাদিস সংরক্ষণের শুধু এ একটি মাধ্যমই ছিল না, বরং এছাড়া আরও অনেক মাধ্যম ব্যবহৃত হয়েছিল।
এক. মুখস্থ করার মাধ্যমে সংরক্ষণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে আলোকিত করুন, যে ব্যক্তি আমার কোনো একটি বাণী ভালোভাবে শ্রবণ করে মুখস্থ করেছে এবং সে যেভাবে শুনেছে ঠিক সেভাবে অন্যের কাছে বর্ণনা করেছে। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৩৬৬০)
ওই হাদিসটিতে বর্ণিত সুসংবাদ প্রাপ্তির আশায় সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী যুগে বর্ণনাকারীরা হাদিস মুখস্থ করতেন এবং তা মুখস্থ রাখা ও সঠিকভাবে অন্যের কাছে পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টায় মগ্ন থাকতেন। এমনকি সাহাবায়ে কেরামের একটি দল তো নিজের কাজ-কারবার ছেড়ে এ আশায় মসজিদে নববিতে এসেই পড়ে থাকতেন। তাদের জীবনকে এ পথে ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। আর এমনিতেই আরবজাতির স্মৃতিশক্তির প্রখরতা সবার কাছে প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত। তারা নিজেদের পূর্বপুরুষদের জীবন বৃত্তান্তসহ বিস্তারিত বংশতা লিকা পূর্ণাঙ্গ মুখস্থ রাখত। এমনকি তাদের ঘোড়া ও উটগুলোর বংশ তালিকাও মুখস্থ রাখত। বিভিন্ন কবির হাজারও কবিতা একেকজনের কণ্ঠস্থ ছিল। আরবদের নিজেদের স্মৃতিশক্তির এতটাই গর্ব ছিল যে অনেক কবি তাদের কবিতাকে লিখে রাখাকে দোষণীয় মনে করতেন। কেউ কেউ লিখে রাখলেও এতে নিজের স্মৃতিশক্তির ত্রুটি প্রকাশের ভয়ে তা লুকিয়ে রাখতেন। (আল-আগানি ৬/৬১)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিরা তাদের এ অনন্য স্মৃতিশক্তিকে কোরআন ও হাদিস মুখস্থ করার কাজে লাগিয়েছিলেন, যাদের অন্তরে এ কথা বদ্ধমূল ছিল যে কোরআনের পরে হাদিসই হলো শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। তাই বলাবাহুল্য যে কবিতা মুখস্থ করার চেয়ে হাদিস মুখস্থ করার প্রতি তাদের মনোযোগ অতুলনীয়ভাবে বেশি ছিল। নিচের ঘটনাটির দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিশক্তির প্রখরতার একটি অনুমান করা যায়: একবার মদিনার গভর্নর মারওয়ান আবু হুরায়রা (রা.), যিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে ৫৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছিলেন, তাকে না জানিয়ে তার স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে তাকে স্বীয় ঘরে দাওয়াত করেন। অতঃপর তাকে কিছু হাদিস শুনানোর জন্য আরজ করেন। মারওয়ান আগেই একজন লেখককে পর্দার আড়ালে আবু হুরায়রা (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসগুলো লেখার নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বেশ কিছু হাদিস শোনালেন এবং লেখক তা লিখে রাখল। এক বছর পর আবার গভর্নর মারওয়ান আবু হুরায়রা (রা.)-কে দাওয়াত করেন এবং গত বছর বর্ণনাকৃত হাদিসগুলো পুনরায় শোনানোর জন্য আরজ করেন। আর এদিকে আগের মতো এবারও ওই লেখককে আড়ালে থেকে গত বছর লিখিত হাদিসসগুলোর সঙ্গে মেলাতে দায়িত্ব দিয়ে রাখলেন। আবু হুরায়রা (রা.) আগে বর্ণিত হাদিসগুলোই শোনাতে লাগলেন এবং লেখক আড়াল থেকে মেলাতে থাকল। শেষে দেখা গেল যে গত বছর বর্ণিত হাদিসগুলোয় কোনো বেশকম ও আগপিছ ছাড়া সম্পূর্ণটাই তিনি শুনিয়ে দিলেন। (তারিখে দিমাশক, ইবনে আসাকির ২০/৮৯, সিয়ারু আলমিন নুবালা ২/৫৯৮)
হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাসে হাজারো লোকের এ জাতীয় অসংখ্য ঘটনা সংরক্ষিত আছে। হাদিস বর্ণনাকারীরা তাদের এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তিকে হাদিস সংরক্ষণের কাজে লাগিয়েছিলেন।
দুই. পরস্পর মুজাকারার মাধ্যমে সংরক্ষণ
প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ মুখস্থকৃত হাদিসগুলো পরস্পর মুজাকারা করতেন—একে অন্যকে শোনাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘উপস্থিতরা অনুপস্থিতদের কাছে আমার কথা পৌঁছে দেবে। ’ (সহিহ বোখারি: হা. ১৭৩৯)
তিনি আরও বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। ’ (বুখারি, হাদিস: ৩৪৬১)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে আলোকিত করুন, যে ব্যক্তি আমার কোনো একটি বাণী ভালোভাবে শ্রবণ করে মুখস্থ করেছে এবং সে যেভাবে শুনেছে ঠিক সেভাবেই অন্যের কাছে বর্ণনা করেছে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৩৬৬০)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তিকে কোনো ইলম জিজ্ঞেস করা হলো, আর সে জানা সত্ত্বেও তা লুকালো, তাকে পরকালে জাহান্নামের আগুনের লাগাম পরানো হবে। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৬৫১)। এজন্য সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী উম্মতদের বিশাল এক শ্রেণির লোকদের পেশাই ছিল নিজ নিজ মুখস্থকৃত হাদিসগুলো পরস্পর মুজাকারা করা এবং একে অন্যকে শোনানো।
তিন. সুন্নাহ অনুসারে আমলের ধারাবাহিকতায় সংরক্ষণ
হাদিস ও সুন্নাহ শুধু কোনো তাত্ত্বিক ফর্মুলার নাম নয়; বরং তা তো জীবনবিধান ও দ্বিনের দলিল। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে আমলি জিন্দেগিতে প্রাকটিক্যালি সুন্নাহ শিখিয়ে গিয়েছিলেন। তদ্রুপ সাহাবিরা পরবর্তী মুসলিমদের, অতঃপর তারা এর পরবর্তীদের, এভাবে ক্রমধারায় ধারাবাহিক আমলের মাধ্যমেও তা সংরক্ষিত হয়েছে। আর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যে জিনিস আমল না করে শুধু মুখস্থ করা হয় তা স্মরণে থাকে কম, আর যা মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত আমলেও রাখা হয় তা কেউ ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও ভুলতে পারবে না।
চার. লেখনীর মাধ্যমে সংরক্ষণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) যদিও ইসলামের শুরু যুগে কোরআন ছাড়া অন্য কিছু লিখতে নিষেধ করেছিলেন, যাতে আল্লাহর সরাসরি কালামের সঙ্গে অন্য কথা মিলে না যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ ভয় কেটে যাওয়ার পর তিনি হাদিসও লেখার অনুমতি দিয়েছিলেন এবং হাদিস লিখতে উদ্বুদ্ধও করতেন। এক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করলে তিনি ইরশাদ করেন, ‘তুমি তা সংরক্ষণে তোমার হাত থেকে (লেখনীর মাধ্যমে) সাহায্য গ্রহণ করো। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৬৬৬)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘ফাতহে মক্কার বছর খুজাআ গোত্র জাহেলি যুগের এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে বনু লাইসের এক ব্যক্তিকে হত্যা করল। নবী করিম (সা.)-কে তা জানানো হলো। তিনি তখন বাহনে আরোহণ করে এ বিষয়ের বিধানসংক্রান্ত একটি খুতবা দিলেন। দীর্ঘ খুতবা শেষ হলে এক ব্যক্তি (আবু শাহ) বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, এ কথাগুলো আমাকে লিখে দিন। নবী (সা.) তাকে লিখে দেওয়ার আদেশ করেন। ’ (বুখারি, হাদিস: ২৪৩৪)
এজন্যই সাহাবায়ে কেরাম ও যুগে যুগে হাদিসবিশারদরা হাদিস সংরক্ষণে লেখার আমল চালু রেখেছেন। স্বয়ং নবী (সা.) কোরআনে কারিম ছাড়াও এর বাইরে শরিয়তের বহু বিধিবিধান লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। নবী (সা.)-এর অনুমতিক্রমে সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন বিষয়ের হাদিস লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই লিখিত দলিলগুলো কোনোটি হুবহু আবার কোনোটির বিষয়বস্তু হাদিসের কিতাবসমূহে সংকলিত হয়েছে।
No comments be the first to comment
views: 39 1 month ago
views: 33 1 month ago
views: 37 1 month ago
views: 46 1 month ago
views: 44 2 month ago
views: 48 2 month ago
views: 56 3 month ago
views: 118 5 month ago
views: 96 5 month ago
views: 117 5 month ago